প্রধান তিনটি মঙ্গলকাব্যে শেষ কাব্য হল ধর্মমঙ্গল। এই কাব্যে দক্ষিণ পশ্চিম বাংলা লৌকিক অনার্য দেবতা ধর্ম ঠাকুর মাহাত্ম্য পূজা-প্রচারের কথা বলা আছে তাই এর নাম ধর্মমঙ্গল। এই পুজো বিশেষত ডোম জাতিরা করে।
কবিগন
এই কাব্যের আদি কবি ময়ূরভট্ট এবং শ্রেষ্ঠ কবি ঘনরাম চক্রবর্তী। এছাড়াও প্রধান কবিরা হলেন রুপরাম চক্রবর্তী, শ্যাম পন্ডিত, ধর্মদাস, রামদাস আদক, সিতারাম দাস, যাদুনাথ বা যাদবনাথ পন্ডিত, হেলারাম চক্রবর্তী ও মানিক রাম গাঙ্গুলী।
মূল কাহিনী
এই কাব্যের দুটি কাহিনী আছে-
১. হরিশচন্দ্রের কাহিনী
২. লাউসেনের কাহিনী।
১. হরিশচন্দ্রের কাহিনী
ধর্মমঙ্গল কাব্যের হরিশচন্দ্রের কাহিনীটি অতি প্রাচীন বলে মনে করা হয়। এই কাহিনীতে দেখা যায় রাজা হরিশচন্দ্র ও তার স্ত্রী মদনা, এরা ছিল নিঃসন্তান। ওরা মনের দুখে ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছায় বোল্লুকা নদীর তীরে। সেখানে তারা দেখে অনেক ভক্তরা ধর্মের পূজা করছে। তারাও পুত্র লাভের জন্য ধর্মের পূজা করলেন। ধর্ম ঠাকুর তাদের পুত্র লাভের বর দিলেন কিন্তু একটি শর্ত ছিল পুত্র বয়ঃপ্রাপ্ত হলে তাকে ধর্মের কাছে বলি দিতে হবে। রাজা তাতেই রাজি হয়। এরপর ধর্ম ঠাকুরের পরে তাদের কোলে পুত্র সন্তান জন্মায় যার নাম রাখা হয় লুই চন্দ্র বা লুইধর। সন্তান বড় হলে রাজা রানী তাদের প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে যায়। তাই একদিন ধর্ম ঠাকুর ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে উপস্থিত হয়ে লুইচন্দ্রের মাংস খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে। ব্রাহ্মণের কথা রাখতে রাধারানী তাদের সন্তান লুইচন্দ্রকে কেটে ব্যঞ্জন প্রস্তুত করে। এবং এই ব্যঞ্জন ভক্ষণ করার আগেই ধর্ম ঠাকুর নিজের স্বরূপ ধারণ করেন। এবং তিনি রাজা রানীর এই অদ্ভুত নিষ্ঠাকে প্রশংসা করলেন ও তাদের সন্তান লুইচন্দ্রকে ফিরিয়ে দিলেন। অক্ষত অবস্থায় সন্তানকে পিয়ে রাজা রানী খুব খুশি হলেন। আসলে রাজা রানী লুইচন্দ্রকে কাটেনি ধর্ম লুইকে নিজের কোলে লুকিয়ে রেখেছিলেন। ধর্ম ঠাকুর পরীক্ষা নেওয়ার জন্য রাজা-রানীর সামনে রেখেছিলেন মায়া- লুই কে যাকে তারা কেটেছিলেন।
২. লাউসেনের কাহিনী
ধর্মমঙ্গল কাব্যের দ্বিতীয় অর্থাৎ প্রধান কাহিনী হল লাউসেনের কাহিনী। লাউসেনের অদ্ভুত বিরক্তের কাহিনী কে কেন্দ্র করে এই ধর্মমঙ্গল কাব্য রচিত হয়েছে এই কাহিনীটির সঙ্গে রাঢ়ভূমির পাল যুগের ইতিহাসের ক্ষীণ সম্পর্ক আছে। এবং এই কাহিনীটি পৌরাণিক ঐতিহ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত।
গৌড়েশ্বরের রাজা কর্ণ সেন ও রানী রঞ্ঝাবতীর একমাত্র পুত্র হলেন লাউসেন। চণ্ডীর বর পুত্র ইছাই ঘোষ বলে এক দুর্দান্ত সামন্তের আক্রমণে কর্ণ সেন আহত হয় ও তার ৬ ছেলে মারা যায়। তখন গৌড়েশ্বরের প্রিয় সামন্ত কর্ন সেন কে গৃহবাসী করবার জন্য নিজ শ্যালিকা রঞ্জাবতীর সঙ্গে বৃদ্ধ কর্ণ সেনের বিয়ে দেন। বিবাহের পর কন্যাশেন ময়না ঘরে নতুন সামন্তের পদে অধিষ্ঠিত হন।রঞ্জাবতীর দাদা মহামদছিলেন গৌড়েশ্বরের মন্ত্রী। তিনি বোনের সঙ্গে বৃদ্ধ কর্ণের বিয়ে হওয়ার খবর পিয়ে ক্ষিপ্ত হন। এবং বারবার কর্ণ কে পুত্রহিনা বলে গালি দেন। অভিমানে বিচলিত হয়ে রঞ্জা ধর্ম ঠাকুরের কাছে নিদারুণ কৃচ্ছতা অবলম্বন করে অবশেষে ধর্ম আবির্ভূত হয়ে তাকে পুত্র বর দিলেন। যথা কালে রঞ্ঝাবতী পুত্র লাভ করলেন এবং তার নাম রাখলেন লাউসেন। অন্যদিকে মহামদ শিশুকাল থেকে লাউ সেনকে বিনাশ করার চেষ্টা করছেন কিন্তু ধর্মের কৃপায় লাউ সেন প্রতিবারই রক্ষা দিয়েছে। আমি লাউসেন্ড যুবক হলে পথের মধ্যে ভয়ানক জন্তু জানোয়ার মেরে সে তার অসাধারণ বীরত্বের খ্যাতি অর্জন করে। শক্তি পরীক্ষার জন্য লাউ সেন গৌড়ে গেলে মহামথ লাউসেনকে বন্দী করে কিন্তু যে তার পারদর্শিতা দেখে কারা মুক্ত হন। এরপর ময়নাগড়ে ফেরার পথে কালু ডোম ও তার স্ত্রী লখাইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। এবং কালুকে করে সেনাপতি। এরপর মহামদের চক্রান্তে লাউসেন গেল কামরূপ রাজাকে দমন করতে। মোহাম্মদ ভেবেছিল কামরূপের প্রতাপশালী রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে লাউসেনের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু ধর্ম ঠাকুরের ইচ্ছায় লাউসেন কামরূপের রাজাকে হারিয়ে তার কন্যা কলিঙ্গাকে বিয়ে করে দেশে ফিরলেন। লাউসেনের এই জয় দেখে মোহামদ আবার চক্রান্ত করে লাউসেনকে শিমুল রাজ্যে আক্রমণ করতে পাঠালেন। সেখানেও পুনরায় একই ঘটনা। লাওসেন শিমুল রাজকন্যা কানাডাকে বিবাহ করে নিয়ে ফিরলো। অন্যদিকে মোহাম্মদের ক্রোধ বাড়তে থাকে। এরপর তারই চক্রান্তে অজয় নদীর তীরে লাউসেনের সঙ্গে ইছায় ঘোষের সঙ্গে লাউসেনের প্রবল যুদ্ধ হলো। যুদ্ধে ইছাই পরাজিত হয়। এবার মোহামদ একটু অন্যরকম চক্রান্ত করলেন। তিনি গৌড়েশ্বর কে বললেন লাউসেন যদি ধর্মের বর পুত্র হয় তাহলে তাকে পশ্চিমে সূর্যোদয় ঘুরিয়ে দেখাতে হবে নয়তো তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।ধর্মের কৃপায় এই অসাধ্য টি ও সম্ভব হলো। এরপর চারিদিকে লাউসেনের জয়জয়কার পড়ে। যখন লাউ সেন হাকুন্দে তপস্যা করছে সেই সুযোগে ময়নাগড় আক্রমণ করলো মহামদ এই যুদ্ধের সপত্নী কালুরায় মারা যায়। লাউসেনের প্রথম স্ত্রী কলিঙ্গা, বীর বিক্রমের যুদ্ধ করে প্রাণ ত্যাগ করে। শেষঅব্দি বীরাঙ্গনা কানাডার হাতে পরাজিত হয়ে মোহাম্মদ পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।এরপর লাউসেন দেশে ফিরে ধর্ম ঠাকুরের স্টপ করে সকলকে বাঁচিয়ে তোলেন। এবং মতে ধর্ম ঠাকুরের পূজা প্রচারিত হয়। এবং মোহামদ তার কৃতকর্মের জন্য কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হন। অবশ্য লাউসেনের দোয়ায় তিনি রোগমুক্ত হন। এবার লাউসেনের কাল পূর্ণ হলে পুত্র চিত্র সেনকে রাজ্য দিয়ে তিনি স্বর্গে যাত্রা করলেন।