বাঙালি পোশাকের উৎপত্তি ও বিবর্তন মাধ্যম

Moumita Jana Avatar

সভ্য মানব সমাজের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করা। পরিচ্ছদ কথার অর্থ আবরণ বা আচ্ছাদন অর্থাৎ মানুষ নিজের লজ্জা ঢাকতে পোশাক পরিধান করে। তবে দিনে দিনে পোশাকের বাহারি রূপ ধরা পড়ছে, তাই আজকের আলোচনা এই পোশাকের উৎপত্তি হলো কোথা থেকে?

সমগ্র ইতিহাস চর্চার মধ্যে পোশাক পরিচ্ছদের ইতিহাস চর্চাও অনেকখানি গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের পোশাকের মাধ্যমেই তার সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক পছন্দ-অপছন্দ নানা দিক ফুটে ওঠে। 

প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত পোশাকের বিবর্তন ও পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। প্রাচীন ও মধ্যযুগের অনেক ভাস্কর্য, পান্ডুলিপি চিত্র থেকে আমরা আগেকার পোশাক পরিচ্ছদ সম্পর্কে অনেকখানি ধারণা পাই।

আজ থেকে প্রায় পঁচিশ হাজার বছর আগে প্রাচীনকালের মানুষ নিজেদের ঠান্ডা, গরম প্রভৃতি আঘাত থেকে বাঁচাতে গায়ে টেনে নিয়েছিল আবরণ সেটা সাধারণত ছিল পশুর চামড়া ও গাছের বাকল। প্রাচীন ভারত উপমহাদেশে গাছের বাকল পাতলা করে তৈরি করা হতো খৌম। অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায় মৌর্য যুগের বঙ্গদেশে কার্পাসের সুতোর কাপড় তৈরি হতো। তার অনেক আগে থেকে এ দেশে সন পাঠ প্রভৃতি গাছের বাকল থেকে মানুষ সুতো তৈরি করতে জানতো। মনে করা হয় প্রায় ৪০ হাজার বছরের আগে সেলাই ছুচের সন্ধান পাওয়া যায়। এই সুতো থেকে তৈরি হতো সুতিবস্ত্র তবে মূলত কাপড় বোনা হতো কার্পাস,পাট,রেশম দিয়ে। 

ওই সময় পুরুষরা নিম্নাঙ্গে একখণ্ড কাপড় পড়তো যাকে বলা হয় দুকুল বর্তমানে অনেকটা ধুতির মতোই। ধীরে ধীরে এই দুটি পড়ার মতো অনেক খানি বৈচিত্র লক্ষ্য করা যায় কেউ ধুতুড়ে অংশটা কোমরে জড়িয়ে কাছার মতো করে পড়ে। অনেকে দ্রুতির খোঁজ সামনের দিকে ঝুলিয়ে পরে। তবে ওই সময় অভিজাতরা হাঁটুর নীচ অব্দি ধুতি ও সাধারণ মানুষ খাটো দুটি পোরতো। এবং সেনারা পড়তো মালকোচা ধুতি। পুরুষেরা সাধারণত উর্ধাঙ্গে কিছু পড়তেন না তবে কোন বিশেষ অনুষ্ঠানে কেউ কেউ গায়ে একখন্ড কাপড় নিতেন। 

ওই সময় অর্থাৎ প্রাচীনকাল থেকে দীর্ঘ সময় নারীরাও অনেকখানি পুরুষদের মতো পোশাক পরতো তবে উর্ধাঙ্গে অলংকার ছাড়া আর কিছুই থাকতো না। তবে আভিজাতদের অনেক নারী অর্ধাঙ্গে একটি ওড়নার মতো কাপড় ব্যবহার করতেন। অনেকে সেই কাপড়কে বুকের সামনে থেকে জড়িয়ে পিঠে গিট দিতেন যাকে বলে কাচুলি। ধীরে ধীরে কাপড়ের আয়তন বাড়ায় নারীরা শাড়ি হিসেবে এটিকে পরতে শুরু করে।

 

মনে করা হয় প্রাচীনকালের বাংলায় সেলাই করা বস্ত্র পরিধান করার নিয়ম ছিল না। কিন্তু ওই সময় দাঁড়িয়ে দেখা গেছে মধ্য, উত্তর-পশ্চিম ভারতের সেলাই করা জামা, পাজামার ব্যবহার প্রচলিত ছিল। তবে তামিল গুজরাটি বাঙালি এই নীতি গ্রহণ করেননি। এই নিয়মের ধারা অনুযায়ী এখনো বাঙ্গালীদের মধ্যে দেখা যায় বিয়ের অনুষ্ঠানে ছেলে সেলাই করা বস্ত্র পরে না। ছেলেদের ধুতি পড়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে সম্পন্ন হয়। 

এরপর ধীরে ধীরে বিশেষত বাংলায় ইন্দো – মুসলমান  আগমনের পর বাঙালিদের পোশাকের মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। প্রাচীনকালে বাঙালি নারী পুরুষদের একখণ্ড কাপড়ের জায়গায় মধ্যযুগে মুসলমানদের প্রভাবে তিন খন্ড কাপড় পড়তে শুরু করে। মুকুন্দরামের লেখা থেকে জানা গেছে ১৬ শতকের শেষের দিকে সচ্ছল মুসলমানেরা পড়তেন ইজারা, পাজামা। এবং ধর্মমঙ্গল থেকে জানা যায় মুসলমানদের পোশাক লম্বা জামা ও পাগড়ী।

এরপর ইংরেজরা বাংলায় এলে তাদের পোশাকে ছাপ ও পড়ে বাঙালিদের উপর। প্রথমে আভিজাত ও পরে সাধারণ মানুষের মধ্যেও ইংরেজদের অনুকরণে পোশাক পরার প্রচলন শুরু হয়। ছিল সাধারণত শার্ট ও গলা বন্ধ কোট। এই পোশাকে আমরা এখনো যা চিত্র দেখি তিনি হলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। 

এইভাবে ধীরে ধীরে প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে মধ্যযুগ ও বর্তমান আধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে বাঙালি পোশাকের মধ্যে আধুনিকতার ছাপ ফুটে ওঠে।

Search