মঙ্গলকাব্যের ধারার ইতিহাস এবং এর সময়কাল

Moumita Jana Avatar

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান ধারা হল মঙ্গলকাব্য। সাধারণত মঙ্গলকাব্য বলতে আমরা বুঝি যে কাব্য পাঠ করলে বা শুনলে শ্রোতার মঙ্গল হয় তাকে মঙ্গলকাব্য বলে। 

     এই মঙ্গল কাব্যের বিখ্যাত গবেষক হলেন শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য।

উদ্ভব ও সময়কাল

ত্রয়োদশ শতক থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি ভারতচন্দ্রের কাল পর্যন্ত বঙ্গ সাহিত্যে অর্থাৎ মুসলমান শাসনকালে মঙ্গলকাব্যগুলি সৃষ্টি হয়।

নামকরণ

এই কাব্যের নাম মঙ্গল দেওয়ার বিভিন্ন কারণ রয়েছে –

  •   এই কাব্যের গানগুলি এক মঙ্গলবার থেকে আর এক মঙ্গলবার পর্যন্ত গাওয়া হতো তাই একে অষ্টমঙ্গলা ও বলা হয়। 
  • এই কাব্যে সাধারণত দেব দেবীর মাহাত্ম্য বর্ণিত হতো। যার শুনলে বা দেখলে মানুষের মঙ্গল হয়। 
  • মঙ্গলকাব্যে আরেকটি নাম রয়েছে যেটি হল রয়ানি অর্থাৎ রাত জেগে জেগে এই কাব্য পরিবেশন করা হয় বলে একে রয়ানি বলে।

ছন্দ

প্রধানত মঙ্গলকাব্য অক্ষরবৃত্ত পয়ার ছন্দে লিখিত। মধ্যযুগের এই ছন্দকে পাঁচালী ছন্দও বলা হয়। এছাড়াও মঙ্গলকাব্যে ত্রিপদি ছন্দ ও একবলি ছন্দ রয়েছে। ত্রিপদী ছন্দকে লাচারী ছন্দ ও ললিত ছন্দও বলে।

বৈশিষ্ট্য

মঙ্গলকাব্যের প্রধানত দুটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে-

১. গঠনগত বৈশিষ্ট্য

  • বন্দনা খন্ড 
  • গ্রন্থ উৎপত্তির কারণ ও আত্ম বিবরণী অংশ।
  • দেব খন্ড 
  • নর খন্ড

২. সাধারণ বৈশিষ্ট্য

দেবদেবীর বন্দনা ও মাহাত্ম্য প্রচার 

                     প্রতিটি মঙ্গল কাব্যের শুরুতে দেবদেবীর বন্দনা ও মাহাত্ম্য প্রচারের কথা উল্লেখ আছে।

  •  স্বপ্নাদেশ

                    মঙ্গল কাব্যের প্রতিটি কাব্য রচনায় স্বপ্নাদেশ-এর কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ সকল কবিরাই স্বপ্নের আদেশে গ্রন্থ রচনা করেছেন।

  • দেবদেবীর মাহাত্ম্য প্রচার 

                   দেখা গেছে সব মঙ্গল কাব্যের নায়ক-নায়িকায় স্বর্গ থেকে আগত দেবদেবী। তাদের মাহাত্ম্য প্রচারের উদ্দেশ্যেই মর্তে আগমন করেছেন।

  • নারীদের পতিনিন্দা 

                  প্রতিটি মঙ্গলকাব্যে দেখা যায় নায়ক কে মহৎ করে তুলতে প্রতিটি বিবাহ সভায় নারীরা তাদের স্বামীর নিন্দা করে। 

  • বারোমাস্যা 

                 মঙ্গল কাব্যের একটি সাধারন বৈশিষ্ট্য হল বারোমাস্যা যেখানে নায়িকার বারোমাসের সুখ-দুঃখের কাহিনী বর্ণনা করা থাকে। 

  • যুদ্ধের বর্ণনা 

                 প্রায় সকল মঙ্গল কাব্যে যুদ্ধের বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায় 

  • বাঙালি রান্না ও আচার অনুষ্ঠান 

               প্রায় সকল মঙ্গল কাব্যে বিবাহের আচার অনুষ্ঠান ও বাঙালি রান্নার বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। 

  •  বিবিধ 

            মঙ্গলকাব্যে নায়ক নায়িকাদের সাজসজ্জা সৌন্দর্যে বর্ণনা আছে এছাড়াও সংশ্লিষ্ট নগরী শ্মশান-মহাস্মান প্রভৃতির উল্লেখ আছে।

মঙ্গলকাব্যের ভাগ

মঙ্গলকাব্যকে সাধারণত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়-

১. প্রধান মঙ্গলকাব্য

প্রধান মঙ্গলকাব্যে তিনটি মঙ্গলকাব্য রয়েছে যথা মনসামঙ্গল, চন্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল।

২. অপ্রধান মঙ্গলকাব্য

এই তিনটি মঙ্গলকাব্য ছাড়া বাকি যত মঙ্গলকাব্য রয়েছে সবগুলি অপ্রধান মঙ্গলকাব্য যেমন- রায়মঙ্গল, ষষ্ঠী মঙ্গল, শিবায়ন মঙ্গল, অন্নদামঙ্গল, প্রভৃতি।

প্রধান মঙ্গল কাব্য গুলির সংক্ষিপ্ত আলোচনা-

মনসামঙ্গল

মঙ্গলকাব্যের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন কাব্য হল মনসামঙ্গল।এই কাব্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনসা বলে একে মনসামঙ্গল কাব্য বলে। মনসা মূলত অনার্য দেবী। বিশেষজ্ঞদের অনুমান অনুযায়ী মনে করা হয় খ্রিস্টীয় দশম থেকে একাদশ শতাব্দীতে বাংলায় মনসা পূজা প্রবর্তিত হয়।মনসামঙ্গল কাব্যের আদি কবি ছিলেন কানাহরি দত্ত। এবং শ্রেষ্ঠ কবি নারায়ণ দেব বিজয় গুপ্ত। এছাড়াও এই কাব্যে প্রধান কবিগুলি ছিলেন- কেতকা দাস, নারায়ণ দেব, দ্বিজ বংশীদাস, বিপ্রদাস পিপিলাই ও বিজয় গুপ্ত। এই কাব্যের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রগুলি হল মনসা, চাঁদ সওদাগর, মা সনকা, বেহুলা ও লক্ষিন্দর।

চন্ডীমঙ্গল

মঙ্গলকাব্যে ইতিহাসে মনসামঙ্গল কাব্যের পর চন্ডীমঙ্গল কাব্যের কাহিনী ধরা পড়ে। দেবী চণ্ডী প্রচারে এই কাহিনী বলে একে চন্ডীমঙ্গল কাব্য বলা হয়। এই কাব্যের প্রধান কবিগন হলেন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, মানিক দত্ত, দ্বিজ মাধব, দ্বিজ রামদেব, মুক্তারাম সেন, জয় নারায়ন সেন, হরিনাম প্রমূখ। এই কাহিনীতে দুটি খণ্ড রয়েছে-

১. আখিটিক খন্ড(প্রধান চরিত্র-কালকেতু,ফুল্লরা)

 ২.বণিক খণ্ড(প্রধান চরিত্র-ধনপতি সওদাগর)

ধর্মমঙ্গল

প্রধান তিনটি মঙ্গলকাব্যে শেষ কাব্য হল ধর্মমঙ্গল। এই কাব্যে ধর্ম ঠাকুর নামে এক লৌকিক দেবতার পূজা-প্রচারের কথা বলা আছে তাই এর নাম ধর্মমঙ্গল। এই পুজো বিশেষত ডোম জাতিরা করে।এই কাব্যের আদি কবি ময়ূরভট্ট এবং শ্রেষ্ঠ কবি ঘনরাম চক্রবর্তী। এই কাব্যের দুটি কাহিনী আছে-

১. হরিশচন্দ্রের কাহিনী 

২. লাউসেনের কাহিনী।