বাঙালি মানেই তাদের সব চিন্তাভাবনা তাদের সংস্কৃতিকে ঘিরে। আসাক পোশাক উত্তর পারবেন সামাজিক রীতি এই সকল সংস্কৃতির মাঝে বাঙালিরা খাদ্যাভাসের সংস্কৃতিকে কোনভাবেই বাদ দেয় না। আমরা সকলেই জানি বাঙালি মানেই খাদ্য রসিক।
তাই আজকের আলোচনায় জানবো বাঙালি খাদ্যাভাসের সংস্কৃতির ইতিহাস
প্রাচীন মধ্যযুগ থেকে বাংলার খাদ্যাভাসে এসেছে নানান পরিবর্তন ও বৈচিত্র্য। সেই সময় গোটা ভারত দখল করে আছে পার্সি, তুর্কি, আবগান,আরব। পনেরশো শতকে পর্তুগিজ, ষোড়শ শতকে ইংরেজ এবং ওলন্দাজ ফরাসিরা ষোড়শ শতকের শেষের দিকে ভারতে প্রবেশ করে। এরপর মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রায় সাড়ে আট দশকের মাথায় বাংলার রাজধানী হিসেবে মর্যাদাবায় ঢাকা এই সব কিছুর হাত ধরে বাংলার খাদ্যাভাসের পরিবর্তন ঘটে। এই খাদ্যাভাসের ইতিহাস আমরা বিভিন্ন স্বাস্থ্য গ্রন্থ থেকেও জানতে পারি।
সকলেই জানি বাংলার প্রধান খাদ্য ভাত। এখান থেকেই বোঝা যায় এ দেশে প্রথম উৎপন্ন ফসল হলো ধান। চতুর্দশ শতাব্দীর পইঙ্গল গ্রন্থ থেকে জানা যায় রমণীরা তাদের স্বামীকে কলা পাতায় গরম ভাত, ঘি, মৌরালা মাছ সঙ্গে পাট শাক পরিবেশন করলে সেই স্বামী হয় ভাগ্যবান।এছাড়াও চর্যাপদের বৌদ্ধ গান পঞ্চাতশ শতকে কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত চৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থ প্রভৃতি থেকে ভাতের বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। এই থেকে প্রমাণিত হয় বাঙালিদের প্রধান আহার্য ভাত।
তবে বাঙালিরা কি শুধু ভাত খেয়ে দিন পার করতো? তা কিন্তু নয় তার পাশাপাশি বাঙালিরা খেতো রুটি,লুচি, পরোটা সঙ্গে নানান পদ।
কবি কঙ্কন মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল কাব্য থেকে খাদ্য হিসেবে কিছু দেশীয় শাক পাতার কথা জানা যায়। পঞ্চদশ শতকে মনসামঙ্গল ও চৈতন্য চালিতামৃত গ্রন্থে লাউ, কুমড়ো, বেগুন, পটল, উচ্ছে, সিম, নিম প্রভৃতি নিরামিষ পদের কথা জানা যায়।শ্রীচৈতন্যদেবের সময়কালে বৈষ্ণব উৎসবে নিরামিষ খাওয়ার প্রচলন ছিল। নিরামিষ খাবার মানেই লুচি, ছক্কা, শাক, মিষ্টি প্রাধান্যই বেশি।
এরপর সপ্তদশ শতকে পর্তুগিজদের আগমনে বাংলার খাদ্য তালিকায় বিশেষভাবে জায়গা করে নেয় আলু। এবং পর্তুগিজরা সেই সময় দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আনারস ও পেঁপে আমদানি করতো। সেই সঙ্গে টমেটো ও কাঁচা লঙ্কা ও সেই সময় থেকে খাওয়া শুরু হয়।
পর্তুগিজের এই সময়কাল থেকেই ধীরে ধীরে বাঙ্গালীদের মধ্যে মাছ খাওয়া শুরু হতে থাকে। তবে মাছ খাওয়া শুরু হওয়ার সঠিক দিন জানা না গেলেও মাছ হল বাঙালিদের একটি প্রাচীন খাদ্যাভাস। তাই বলা হয় “মাছের ভাতে বাঙালি”। বিভিন্ন মঙ্গলকাব্য যেমন অন্নদামঙ্গল মনসামঙ্গল থেকে মধ্য ভজন এর কথা জানা যায়। এছাড়াও বাঙ্গালীদের বিভিন্ন উৎসবে আবশ্যিকভাবে মাছের প্রয়োজন হয়। যেমন বিয়ে বাড়ির গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের তথ্যে রুই মাছ সাজানো থাকে। এছাড়াও জামাই শ্বশুরবাড়িতে গেলে মাছ নিয়ে যাওয়ার প্রচলন আছে।
এরপর বলা যাক মাংসের কথা। চর্যাপদের ভুসু কুপার গানে মাংস খাওয়ার বর্ণনা পাওয়া যায়। বিশেষ করে চর্যাপদ এর লেখা থেকে হরিণের মাংসের সুখ্যাতি পাওয়া যায়। তবে মধ্যযুগ থেকেই গরু, খাসি প্রভৃতি মাংস খাওয়ার প্রচলন ছিল।
তবে মিষ্টি ছিল বাঙালির খাদ্যাভাসের অন্যতম একটি খাবার। যা কোনভাবেই বাদ দেওয়া চলে না। প্রাচীনকালের মিষ্টি মানে ছিল হাতের তৈরি বিভিন্ন নাড়ু যেমন- চিড়ে খই নাড়ু, নারকেল নাড়ু, ঘুরে নাড়ু এবং পিঠেপুলি, পায়েস ও দুধে তৈরি নানান মিষ্টি। এবং সেই মিষ্টি বিশেষ করে দেব খাদ্য হিসেবে পরিচিত ছিল। যেমন শ্রীকৃষ্ণের প্রিয় ননী ও মাখনের কথা আমরা সবাই জানি।
এরপর অষ্টাদশ শতকে পর্তুগিজদের হাত ধরে বাংলায় ছানার আগমন ঘটায় খাদ্য তালিকায় ছানা জাতীয় মিষ্টি যেমন রসগোল্লার, সন্দেশ, চমচম, এর আবির্ভাব হয়। মনে করা হয় রসগোল্লা প্রথম তৈরি হয় উড়িষ্যায়। এরপর মুঘলদের আমলে জনপ্রিয় মিষ্টি ছিল কালোজাম এছাড়াও ময়রার তৈরি নানান ধরনের মিষ্টি বঙ্গ দেশে খ্যাতি অর্জন করে। সেই সময় বাংলার প্রধান নগরগুলি হয়ে ওঠে মুর্শিদাবাদ বর্ধমান, বিষ্ণুপুর, কৃষ্ণনগর, ঢাকা, নাটোর।
এরপর মুঘলদের হাত ধরে বাংলায় খাওয়া শুরু হয় কাবাব, পোলাও, কালিয়া, পোক্তা প্রকৃতি। জানা যায় সেই সময় বর্ধমান মহারাজার প্রধান খাবার হিসেবে ছিল কাবাব। মুঘলদের সময় থেকেই খাবারে আদা রসুনের ব্যবহার শুরু হয়।
১৯২০ শতকে রেস্টুরেন্টে অনেক ইংরেজি খাবারের উদ্ভব হয়। ১৯১৭ সালে “বনেদি কলকাতার ঘরবাড়ি”গ্রন্থ থেকে একটি ভোজের আয়োজন এর বিবরণ পাওয়া যায় যাতে থাকে একশ সতেরোটি পদের রান্না তার মধ্যে ছিল কাবাব, কোপ্তা, ফ্রাই, কাটলেট ইত্যাদি। এছাড়াও কেক, বিস্কুট উল্লেখযোগ্য।
সবকিছু মিলিয়ে প্রমাণিত বাঙালি ভোজন রসিক। প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে দিন দিন খাবারের বাহার বেড়েই চলেছে। সব স্বাদের খাবার পরিপাটি করে খাওয়াই হলো বাঙালিদের ঐতিহ্য।