মধ্যযুগে প্রাচীন মঙ্গল কাব্য হল মনসামঙ্গল। এই কাব্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনসা। পদ্ম বনে শিবের মন থেকে মনসার জন্ম হয় তাই মনসার আরেক নাম পদ্মাবতী এবং মনসামঙ্গল কাব্যকে বলা হয় পদ্মাপুরাণ কাব্য। এছাড়াও মনসার নাম কেতকা। মনসাভক্ত কবিরাও নিজেদের কেতকা দাস বলতেন। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের মনসামঙ্গলের একজন বিখ্যাত কবি ক্ষেমানন্দ নিজের নামের সঙ্গে কেতকা দাস শব্দটি ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ তার পুরো নাম হল কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ।বিশেষজ্ঞদের অনুমান অনুযায়ী মনে করা হয় খ্রিস্টীয় দশম থেকে একাদশ শতাব্দীতে বাংলায় মনসা পূজার প্রবর্তিত হয়
কবিগন
মনসামঙ্গল কাব্যের আদি কবি ছিলেন কানাহরি দত্ত। এবং শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন নারায়ন দেব, বিজয় গুপ্ত। এছাড়াও এই কাব্যে প্রধান কবিগুলি ছিলেন- কেতকা দাস, নারায়ণ দেব, দ্বিজ বংশীদাস, বিপ্রদাস পিপিলাই ও বিজয় গুপ্ত প্রমূখ।
তবে সাহিত্যের ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সুকুমার সেন ও অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার মনসামঙ্গল কাব্যগুলিকে মূলত তিনটি ধারায় বিভক্ত করেছেন। প্রত্যেক ধারা অনুযায়ী কবির নাম
১. রাঢ়ের ধারা:
বিপ্রদাস পিপলাই, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ, বিষ্ণু পাল।
২. পূর্ববঙ্গের ধারা:
বিজয় গুপ্ত নারায়নদেব, দ্বিজবংশী দাস
৩. উত্তরবঙ্গ বা কামরূপীয় ধারা:
তন্ত্রবিভূতি, জগজ্জীবন ঘোষাল, জীবন মৈত্র।
মনসামঙ্গল কাহিনী
মনসামঙ্গলের মূল কাহিনী- বেহুলা লক্ষিন্দর।
মূল চরিত্রগুলি হল-মনসা, চাঁদ সওদাগর, মা সনকা, বেহুলা ও লক্ষিন্দর।
মনসা ছিলেন শিবের মানস কন্যা। মহাদেবশিবের এত ভক্ত থাকার সত্বেও তার কন্যা মনসার জগতে কোন প্রাধান্য ছিল না। সমাজে কিভাবে মনসা নিজের পুজো প্রচলিত করবে সেই নিয়ে মহাদেবের কাছে পরামর্শ চাইলে মহাদেব বলেন তার কোনো মহা ভক্ত বা সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি যদি তার পূজা করে তাহলেই এই সমাজে মনসার পূজা হবে।
এই সময় সমাজে প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন চম্পক নগরের অধীশ্বর বনিক চাঁদ সদাগর। তিনি জগত পিতা শিবের মহাভক্ত। মনসা চাঁদের কাছেই পূজা চাইলেন। কিন্তু চাঁদ তা প্রত্যাখ্যান করে। এমনকি তার পত্নী মনসার পুজো করলে চাঁদ পুজোর ঘটে হেতালদন্ডের বাড়ি মারেন। মনোসা ক্ষিপ্ত হয়ে পরিণামে তার ছটি পুত্রকে বিষ দিয়ে হত্যা করে। এরপর চাঁদ সমুদ্রপথে রওনা হলে তার বাণিজ্যের তরী সপ্তডিঙ্গা মধুকর ডুবিয়ে চাঁদকে সর্ব শান্ত করেন। এতকিছুর পরও চাঁদ নিজের প্রতিজ্ঞায় অটল। কিন্তু যে করে হোক চাঁদের কাছ থেকে মনসাকে পুজো পেতেই হবে। তাই তিনি ছলনা করে স্বর্গের নর্তক অনিরুদ্ধ ও নর্তকী ঊষাকে মর্তে পাঠালেন। নর্তক চাঁদের ঘরে লক্ষিন্দর রূপে জন্ম নিলেন। এবং উজানী শহরে চাঁদের এক বন্ধু সাধু বণিকের ঘরে নর্তকি বেহুলা রূপে জন্ম নিলেন। বেহুলা ও লক্ষিন্দর বয়প্রাপ্ত হলে তাদের দুজনকে বিয়ে দেওয়া হয়। চাঁদের এই পুত্রকেও যাতে মনসা বিনাশ করতে না পারে তার জন্য সাতালি পর্বতের লোহার বাসর ঘর নির্মাণ করিয়ে দেয়। তবুও একটা কথাই উঠে আসে, দেবতার সঙ্গে মানুষের বিরোধে মানুষ কি জয়ী হতে পারে? মনসার নির্দেশে লোহার বাসর ঘরে একটি ছিদ্র রাখা হয়। বাসরে বেহুলা ও লক্ষিন্দর ঘুমিয়ে পড়লে দেবী তার অনুচর কালনাগকে পাঠিয়ে দেয়। কালনাগের বিষে বাসর রাতে লক্ষিন্দরের মৃত্যু হয়। এরপর বেহুলা স্বামী লক্ষিন্দরের শব দেহ নিয়ে কলার ভেলায় স্বর্গের উদ্দেশ্যে ভেসে যায়। এবং পন করে যে স্বর্গে গিয়ে স্বামী জীবন ফিরিয়ে আনবে, তা নইলে আর ফিরে আসবেনা। জলপথের নানা বিপদ পেরিয়ে স্বামীকে নিয়ে পৌঁছালো স্বর্গে। এবং দেবতাদের সামনে নাচের মাধ্যমে স্বামীর জীবন ভিক্ষা চায়। দেবতাদের আদেশে মনসা লক্ষিন্দরের প্রাণ ফিরিয়ে দেয় তবে বেহুলাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিলেন মর্তে গিয়ে শশুরকে দিয়ে মনসা পূজা করিয়ে নেবে। কারণ চাঁদ সদাগর মনসার পূজা না করলে মর্তে মনসা পূজা প্রচারিত হবে না। বেহুলা তাতে রাজি হয়। এরপর স্বামী লক্ষিন্দর ও ছয় ভাসুর প্রাণ ফিরে পায় শ্বশুরের নিমজ্জিত বাণিজ্যের নৌকা ও ভেসে ওঠে। বেহুলা লক্ষিন্দর কে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ফেরে। চাঁদের পরিবারে আবার আগের মত চাঁদের হাট বসে। এবং বেহুলা তার শশুরকে মনসা কে পুজো করার কথা বলে। এবার চাঁদ তার বৌমার কথা ফেলতে পারেনি। কিন্তু বলেছিলেন যে হাতে তিনি শিবের পূজা করেন সেই হাতে মনসার পুজো করবেন না। তাই বাম হাত দিয়ে মনসার পূজা সারে। এরপর ধরাধামে দেবী মনসার পূজা প্রচার লাভ করে।