১৯১৬ সালে প্রকাশিত প্রায় হাজার বছরের পুরনো সাহিত্য নিদর্শন হল চর্যাপদ। এটি নব্য ভারতীয় আর্য ভাষার প্রাচীনতম রচনা। এবং বৌদ্ধ তান্ত্রিক সাধকদের সাধন সংগীত তাই চর্যাপদকে বলা হয় গানের সংকলন।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস শুরু হয় চর্যাপদ থেকে। তাই বাংলা ভাষার পূর্ববর্তী রূপ তর্ক-সাপেক্ষ হলেও বাংলা সাহিত্যের আদি বা প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদ।
আবিষ্কার
বাংলায় মুসলমান আধিপত্য বিস্তারের আগে ব্রাহ্মণ সমাজের পীড়নের হাত থেকে রক্ষা পেতে বৌদ্ধরা তাদের শিষ্যদের সঙ্গী করে এবং পুঁথি পত্র সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন এলাকা যেমন- নেপাল, ভুটান, তিব্বতের বিভিন্ন প্রান্তে পালিয়ে যেত। এই ঘটনাগুলিকে কেন্দ্র করে মূলত ১৮৮২ সালে রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে বৌদ্ধ সাহিত্য গ্রন্থে চর্যাপদে অস্তিত্বের কথা জানিয়েছিলেন। এই কথার সূত্র ধরে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তিনবার নেপাল পরিক্রমণ করেন। ১৮৯৭ সালে প্রথমবার নেপাল পরিক্রমণ করে লোকাচার সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করেন। এরপর ১৮৯৮ সালে দ্বিতীয় বার পরিক্রমণে বৌদ্ধ ধর্ম পুঁথিপত্র সংগ্রহ করেন। এবং ১৯০৭ সালে তৃতীয় পরিক্রমণে নেপালের রাজ তরবারির গ্রন্থ শালা থেকে চর্যাচর্যবিনিশ্চয় নামক একটি খন্ডিত পুঁথি উদ্ধার করেন। এরপর চর্যাচর্যবিনিশ্চয়, সরহপাদের দোহা, অদ্বয়-বজ্রের সংস্কৃত সহজামনায় পঞ্জিকা, কৃষ্ণাচার্য বা কাহ্নপাদের দোহা, আচার্য পাদের সংস্কৃত মেখলা নামক টিকা ও আগে আবিষ্কৃত ডাকর্ণব পুঁথি একত্রিত করে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে হাজার বছর পুরান বাঙ্গালা বৌদ্ধগান ও দোহা সম্পাদকীয় ভূমিকা সহ চর্যাপদ প্রকাশ করেন।
চর্যাপদ আবিষ্কার হওয়ার পর তার বিষয়, ভাষা, কাল, সময় প্রভৃতি নিয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণা শুরু হয়।
রচনাকাল
চর্যাপদের রচনাকালের সময়কাল নিয়ে গবেষকদের মতে নানান মতবাদ রয়েছে। প্রবোধচন্দ্র বাগচি ও সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় মতে খ্রিস্টীয় দর্শন ও দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে চর্যাপদ গুলি রচিত। আবার ড. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ ও রাহুল সাংকৃত্যায়ন চর্যাপদের রচনা সময়কালকে আরো ২০০ বছর পিছিয়ে খ্রিস্টীয় অষ্টম ও দ্বাদশ শতাব্দি বলে মত প্রকাশ করেছে। এছাড়াও নানান মতবাদ রয়েছে।
কবি
চর্যাপদের কবিরা সিদ্ধাচার্য নামে পরিচিত ছিল। তিব্বতি ও ভারতীয় কিংবদন্তি তে এরা চৌরাশি সিদ্ধা নামে পরিচিত ছিল। তবে ৮৪ জনের নাম না জানা গেলেও আবিষ্কৃত পুঁথিতে ২৪ জনের নাম পাওয়া যায়। এবং চর্যাপদের আদি কবি বা সিধাচার্য বলা হয় লুই পাদ কে।
পদ সংখ্যা
চর্যাপদের ২৪ জন পদকর্তায় মূল পুঁথির পদ সংখ্যা ছিল ৫০ টি।হরপ্রসাদ শাস্ত্রীআবিষ্কৃত চর্যাপদে লিখিত অবস্থায় পথ পাওয়া গেছিল সাড়ে ৪৬ টি। মুনিদত্ত নামক এক পন্ডিতের সংস্কৃত টিকা সম্বলিত পুঁথিতে পদ পাওয়া গেছিল সাড়ে ৩ টি।
চর্যাপদ তিব্বতি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন কীর্তি চন্দ্র। ১৯৩৮ সালে প্রবোতচন্দ্র বাগচী এ অনুবাদের আবিষ্কার এ জানা যায় চর্যাপদের মোট পদ সংখ্যা ৫১টি।
ভাষা
চর্যাপদের ভাষায় পাঁচটি ভাষার মিশ্রণ পরিলক্ষিত হয়। যথা বাংলা, হিন্দি, মৈত্রী, অসমীয়া ও উড়িয়া। চর্যাপদের ভাষা বাংলা কিনা তা নিয়ে নানান মতভেদ ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। পরে যার অবসান ঘটেছে।
চর্যাপদের ভাষা ছিল বাংলা ভাষার অদ্যাবধি আবিষ্কৃত আদিতম রূপ। এই ভাষা সাধন সংগীতের অস্পষ্ট দুর্বোধ্য ভাষা। তাই প্রাচীন কবিদের মতে এটি সন্ধ্যা বা আলো-আঁধারি ভাষা।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে-
সহজিয়া ধর্মের সকল বই সন্ধ্যা ভাষায় লেখা, “সন্ধ্যাভাষা মানে আলো-আঁধারি ভাষা, কতক আলো, কতক অন্ধকার, খানিক বুঝা যায় খানিকটা বুঝা যায় না”। অর্থাৎ এই সকল উঁচু অঙ্গের ধর্ম কথার ভিতরে একটা অন্য ভাবের কথাও আছে। সেটা খুলিয়া দেখা করিবার নয়। যাহারা সাধন ভোজন করেন তাহারি সে কথা বুঝবেন। আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই।