মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একটি অন্যতম কাব্য হল চন্ডীমঙ্গল। দেবী চণ্ডীর মহিমা গীত নিয়েই গঠিত হয় এই চন্ডীমঙ্গল কাব্য
কবিগণ
চন্ডীমঙ্গল কাব্যের আদি কবি ছিলেন মানিক দত্ত এছাড়া এই কাব্যের জনপ্রিয় কবি মুক্তারাম সেন হরিরাম মুকুন্দরাম চক্রবর্তী নিজ মাধব প্রমূখ।
খন্ড
চন্ডীমঙ্গল কাব্যের প্রধান দুটি খন্ড রয়েছে,
1.অক্ষেটিক খণ্ড(কালকেতু ও ফুল্লোরার গল্পঃ)
2. বণিক খণ্ড (বণিক ধনপতির গল্প)
অক্ষেটিক খণ্ড
এই খন্ডে কালকেতুর গল্পে দেবী কর্তৃক অনার্য ব্যধসমাজে সর্বপ্রথম পূজা গ্রহণের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। দেবীর অনুরোধে তার স্বামী শিব তার ভক্ত নীলাম্বরের সামান্য অপরাধের জন্য অভিশাপ দিয়ে মর্তে পাঠান। মরতে নিলামবর ব্যাধের ঘরে, কালকেতু হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। এবং নীলাম্বরের স্ত্রী ছায়াও স্বামীর অনুমৃতা হয়ে মর্তে ফুল্লরা ব্যাধিনী রূপে জন্ম নিল। যৌবন প্রাপ্তির পর কালকেতু ও ফুল্লরার বিবাহ হয়। তারা দরিদ্র হলেও তাদের সুখী-সংসার ছিল। দেবী এই সুখী দম্পতির ধারা প্রথম পূজা প্রচারের জন্য সচেষ্ট হলেন। কলিঙ্গের বনের পশুদের আবেদনে দেবী কাতর হয়ে স্বর্ণগোধিকা রূপে, কালকেতুর শিকারে যাওয়ার পথে প্রকট হল। সেদিন কালকেতু কোন শিকার পেলেন না। তার মনে হল অধিকার অশুভ দর্শনই সে শিকারে ব্যর্থ হয়েছে। তাই কুরুদ্ধ হয়ে বাড়ি ফেরার পথে ওই স্বর্ণগোধিকাকে ধনু কে ছিলায় বেঁধে বাড়ি নিয়ে এলেন। ভাবলেন একেই পুড়িয়ে খাবেন। বাড়িতে গোধিকাটিকে বেঁধে রেখে কালকে তো ফুল্লোরার উদ্দেশ্যে হাটে রওনা হন। এরই মধ্যে দেবী গোধিকা মূর্তি ছেড়ে অপূর্ব রূপসী রূপ ধারণ করে কালকেতুর কুটির আলো করে বসে থাকেন। ফুল্লরা বাড়ি ফিরে এই সুন্দরী যুবতী কে দেখে অবাক হন। এই যুবতী কে? এই প্রশ্নে দেবী তাকে জানান তোমার স্বামী আমাকে এখানে বেঁধে এনেছে আর আমি এখানেই কিছুদিন থাকতে চাই। এই কথা শুনে ফুল্লরা চিন্তায় পড়ে যায় এবং দেবীকে তাড়াতে নিজের বারো মাসের দুঃখের কাহিনী বিবৃত করতে থাকেন। তবুও দেবী তার সিদ্ধান্তে অটল। এরপর স্বামী কালকেতু ঘরে ফিরলে এই রূপসী যুবতী দেবীর রূপ ধারণ করে। দেবীর অনুগ্রহে কালকেতু পশু শিকার ত্যাগ করলেন এবং দেবীর আশীর্বাদে ধন-সম্পত্তি লাভ করেন । তিনি বন কেটে গুজরাট নগর তৈরি করে সেখানকার রাজা হন। কিন্তু এই নগরে নবাগতদের মধ্যে একজন ধূর্ত প্রকৃতির লোক ছিল ভাঁড়ু দত্ত। তিনি কালকেতুকে মুগ্ধ করে নিজের কাজ গুছিয়ে নিতে লাগল এবং প্রজাদের অত্যাচার করত। এ কথা জানতে পেরে কালকেতু তাকে ভর্তসনা করে। অপমানিত ভারতরতত্ত্ব পাশের রাজ্যে কলিঙ্গে গিয়ে সে দেশে রাজাকে কালকেতুর বারবারন্তের সংবাদ দেয়। এই সংবাদের কলিঙ্গরাজ রুষ্ট হয়ে বেদ রাজা কালকেতুর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন এবং তাকে বন্দী করেন। কারা কক্ষে বসে কালকেতু ,দেবীর আরাধনা করলে দেবী তাকে সান্তনা দিয়ে কলিঙ্গ রাজাকে রাতে দুঃস্বপ্ন দেখিয়ে কালকেতুকে মুক্তি দিলেন। এরপর কালকেতু তার ঘরবাড়ি আবার ফিরে পেলো। এবং কালকেতুর দ্বারা মর্তে দেবীর পূজা প্রচারিত হলো। ক্রমে কাল পূর্ণ হলে কালকেতু ফুল্লোরা মর্তের মায়া ত্যাগ করে স্বর্গে ফিরে গেলেন।
বনিকখন্ড
চন্ডীমঙ্গলের দ্বিতীয় খন্ডটি বণিক খণ্ড। এই খন্ডে ধনপতি সওদাগরের দ্বারা দেবীর পূজা-প্রচারের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। ব্যাধ কালকেতুর দ্বারা পূজা প্রচারের পর সমাজের শীর্ষস্থানে রয়েছিল বণিক সম্প্রদায়। এই বণিকের প্রধান ধনপতি। যদি তার দ্বারা মর্তে দেবী পূজা প্রচারিত হয় তাহলে সমাজের প্রধান সম্প্রদায় বণিকদের মধ্যেও তার দেবী পূজার প্রাধান্য পাবে। তবে ধনপতি দেবী পুজো করায় ছিল আপত্তি। স্বর্গের নর্তকী রত্নমালা অভিশপ্ত হয়ে মরতে ধনপতির প্রথম পত্নী লহনার ফুরতুতো বোন খুললোনা রূপে জন্ম নেয়। দেবী তার দ্বারা নিজের পুজো প্রচারের জন্য সচেষ্ট হন। খুলল না বয়প্রাপ্ত হলে ধনপতি তার সঙ্গে দ্বিতীয় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। বিবাহের পর ধনপতি কিছুকালের জন্য বিদেশ যাত্রায় রওনা হলে ধনপতি প্রথম স্ত্রী লহনা খুলনার উপর অত্যাচার শুরু করে তার সৌন্দর্য নষ্ট করতে দাসী দুর্বলার কুপরামর্শে তাকে প্রতিদিন ছাগল চরাতে যেতে বাধ্য করে। এরমধ্যে খুল্লনা বনের মধ্যে চন্দীপূজা দেখে নিজে মঙ্গলচণ্ডীর পুজো করলেন। ফলে তার দুঃখের দিন শেষ হলো লহনা নিজের ভুল বুঝতে পেরে তাকে আবার ঠাঁই দিল। কিন্তু ধনপতি বাড়ি ফিরে খুল্লনার প্রতি এই অত্যাচারের কথা জানতে পেরে লহরাকে ভর্তসনা করে। কিছুকাল পরে রাজার নির্দেশ আসে ধনপতিকে নৌকা সাজিয়ে সিংহলের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। তখন খুল্লনা সন্তান সম্ভবা তাই স্বামীর মঙ্গল কামনায় সে ঘট পেতে মঙ্গলচন্ডীর পূজা করছিল একথা ধনপতি জানতে পেরে দেবীর ঘটে পদাঘাত করে। ফলে তাকে বাণিজ্যে বেরিয়ে বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। নৌকা প্রায় ডুবে যায়, কোনক্রমে সিংহলে উপস্থিত হলেও তিনি পথে একটি অদ্ভুত দৃশ্য দেখেছেন পদ্ম ফুলের উপর বসে এক সুন্দরী রমণী একটা হাতিকে গিলে ফেলছেন আবার তৎক্ষণাৎ তাকে উদগীরণ করে দিচ্ছেন (দেবীর নাম কমলেকামিনী)। দেবীর মায়ায় এই দৃশ্য অন্য নাবিকরা দেখতে পাননি। ধনপতি এই দৃশ্যের কথা সিংহল রাজার কাছে বলেন রাজা এই কথা বিশ্বাস করে না। এমনকি ধনপতি এই দৃশ্য দেখাতে গিয়ে ব্যর্থ হয় ফলে সে সিংহলের কারাগারে বন্দী হয়। এরপর বহু বছর কেটে যায়। ইতিমধ্যে ধনপতির ছেলে শ্রীমন্ত (মালাধর নামে স্বর্গের অধিবাসী, অভিশপ্ত হয়ে মর্তে খুল্লোনার পুত্র হয়ে জন্মেছে)ক্রমে বড় হয়ে উঠেছে বহুদিন যাবত পিতার কোন সন্ধান না থাকায় মায়ের কাছে অনুমতি নিয়ে নৌকা সাজিয়ে পিতার সন্ধানে রওনা হয়। একই ঘটনা সীমন্তর সাথেও ঘটে এবং সেও কারাগারে বন্দি হয় এই মর্মান্তিক দৃশ্যের মধ্যে পিতা পুত্রের মিলন ঘটে। এরপর দেবীর কৃপায় সিংহল রাজ নিজের ভুল বুঝতে পেরে ধনপতি এবং তার পুত্র সীমন্তকে মুক্তি দেয়। এবং নিজের কন্যা সুশিলার সঙ্গে শ্রীমন্তর মহা ধুমধাম করে বিবাহ দেন। কিছুকাল সিংহলে অতিবাহিত করার পর ধনপতি পুত্র ও পুত্রবধূকে নিয়ে দেশে ফিরে এলেন এরপর পরমভক্তি ভরে দেবীর পূজা করলেন। এইভাবে মর্তে উচ্চ সমাজে সহজে দেবীর পূজা প্রচারিত হলো। কাল্পূর্ন শেষ হলে স্বর্গের রত্নমালা ও মালাধর স্বর্গে ফিরে যায় মতে ধনপতি বিলাপ করার জন্য শুধু পড়ে রইলো।